চেকের মামলা করার আগে সাবধান থাকুন !
বিভিন্ন ব্যাক্তিগত বা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে আমরা চেকের মাধ্যমে টাকা-পয়সা লেনদেন করে থাকি। নগদ টাকা পরিবহনের চেয়ে চেক এর মাধ্যমে টাকা-পয়সা লেনদেন করা অনেক নিরাপদ এবং ঝুকিবিহীন। ব্যাবসায়িক স্বার্থ বিবেচনা করলে চেকের মাধ্যমে লেনদেন করা সহজ ও নিরাপদ।
চেকের লেনদেন করার ক্ষেত্রে কেন সতর্ক থাকবেন?
যে কারনেই চেকে লেনদেন করা হোক না কেন প্রতিবার লেনদেনের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে সতর্ক এবং সচেতনা থাকা উচিৎ। যদি কোন কারনে চেক প্রত্যাখান বা ডিজঅনার করা হোক টাকা উদ্ধারের জন্য আদালতে মামলা দায়ের করার প্রয়োজন হতে পারে।
তাই, চেক গ্রহণের সময় কিছু বিষয়ে সচেতন এবং সাবধান থাকতে হবে যেন ভবিষ্যতে কোন ঝামেলার স্বীকার বা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে না হয়।
চেকের মামলা করতে অবশ্যই করণীয়
মনে রাখতে হবে, চেকের টাকা উদ্ধারের মামলা একটি আইনী পক্রিয়া। আইনী প্রক্রিয়ায় আপনাকে অনেক নিয়ম-নীতি পালন করে তারপর কাঙ্খিত প্রতিকার পেতে হবে।
কাজেই, আগে থেকেই চেকের মামলা এবং চেকের মামলা দায়েরের জন্য এন আই অ্যক্ট এর – ১৩৮ ধারার সকল করণীয় সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।
উপরন্তু, চেকের মামলায় নতুন আইন এবং হাইকোর্ট এর যুগান্তকারী রায়ের মাধ্যমে নতুন কিছু বাধ্যবাধকতা চালু হওয়ায় আগে থেকেই সতর্কতার সহিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নিম্নে কিছু সাজেশন তুলে ধরা হল।
১। চেক দখলে রাখা
যেকোন অবস্থায় চেকটি আপনার দখলে থাকা জরুরী। আপনার নামে চেক আছে কিন্তু সেটা আপনার দখলে নেই! ব্যাস, এই চেক দিয়ে আপনি কিছুই করতে পারবেন না।
২। ডিজঅনার স্লীপ নিরাপদে রাখা
চেক ব্যংক কর্তৃক ডিজঅনার হলে ব্যাংক থেকে যে স্টেটমেস্ট স্লীপ দেয় তা ডিজঅনার স্লীপ নামে পরিচিত। ডিজঅনার স্লীপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দালিলীক স্বাক্ষ্য।
ডিজঅনার স্লীপটি মূল চেকের সাথে সংযুক্ত করে নিরাপদে হেফাজত করা আবশ্যক। মামলা দায়ের এবং স্বাক্ষ্য গ্রহণের সময় এই দুটি ডকুমেন্ট অবশ্যই প্রদর্শন করতে হবে।
৩। যথা সময়ে লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করা
চেক ব্যংকে উত্থাপন করার জন্য চেকে লিখিত তারিখ হতে ৬ (ছয়) মাস যাবত মেয়াদ থাকে। ব্যাংকে উত্থাপন করার পর যদি চেকটি ডিজঅনার হয় তাহলে ডিজঅনার এর তারিখ হতে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করতে হবে।
লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করার ৩০ দিন অথবা নোটিশ চেক দাতা রিসিভ করলে রিসিভ এর তারিখ হতে ৩০ দিন অতিক্রান্ত হবার পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে অবশ্যই আদালতে মামলা করতে হবে। অন্যথায় এনআই অ্যাক্টের ১৩৮ এবং ১৪০ ধারায় মামলা করার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে চেক গ্রহীতা চেকের মামলা করার অধিকার হারাবে।
৪। লিগ্যাল নোটিশ এর মূলকপি সংরক্ষণ করা
লিগ্যাল নোটিশ প্রদানের ক্ষেত্রে অবশ্যই দক্ষ এবং দ্বায়িত্ববান আইনজীবীর সাহায্য নিতে হবে। নোটিশে আইনী সকল বিষয় এবং যুক্তি স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা আবশ্যক। নোটিশ প্রদানের পর নোটিশের একটি কপি আইনজীবী হেফাজতে রাখতে হবে যেন ভবিষ্যতে মামলা করার ক্ষেত্রে আদালতে প্রদর্শন করা যায়।
৫। লিগ্যাল নোটিশ এর ডাক রশিদ এবং এ/ডি সংরক্ষণ করা
লিগ্যাল নোটিশ পোষ্ট অফিসে মাধ্যমে চেক দাতার বর্তমান এবং স্থায়ী ঠিকানায় পাঠাতে হবে। ঠিকানা সঠিক ভাবে জেনে নেয়া উচিৎ কারণ ঠিকানা সঠিক না থাকার কাররে আসামী গ্রেফতার এবং মামলা নিষ্পত্তিতে অনেক সময় লাগে।
নোটিশ পাঠানোর পর পোষ্ট অফিসের রসিদ এবং প্রাপ্তি স্বীকার যত্ন সহকারে হেফাজতে রাখতে হবে। অবশ্য. নোটিশ, ডাক রশিদ এবং এডির কপি আইনজীবীর ফাইলে সংরক্ষিত থাকে।
0৬। পত্রিকায় নোটিশ জারী করলে তার মূলকপি সংরক্ষণ করা
যদি মামলা করার আগে বা পরে পত্রিকায় কোন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় তাহলে পত্রিকা বিজ্ঞপ্তির এবটি কপি সংরক্ষণ করতে হবে।
৭। চেকের লেনদেন সংক্রান্ত কোন লিখিত চুক্তি, অঙ্গিকারনামা বা হলফনামা থাকলে তার কপি
চেকের মামলায় মহামাণ্য হাইকোর্ট ডিভিশান অতি সম্প্রতি একটি যুগান্তকারী রায় প্রদান করেছেন। রায়ে চেকে লেনদেন সংক্রান্ত কোন লিখিত ডকুমেন্ট বা দুই পক্ষের কনসিডারেশন কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
কাজেই, চেকের লেনদেনের ক্ষেত্রে সম্ভব হলে স্ট্যাম্পে লিখিত চুক্তি করে নেয়া ভাল। তবে, চেকের মামলা করতে চুক্তি থাকতেই হবে এ ধারনা ভূল।
জমির দলিল, খতিয়ান, নকশা, মৌজা ম্যাপ কোনটা কোন অফিসে পাবেন
৮। মামলায় উপযুক্ত স্বাক্ষী প্রদান
লেনদেনে সময় উপস্থিত ছিল অথবা লেনদেন বিষয়ে সাম্যক ধারনা আছে এমন ২ জন স্বাক্ষী থাকা জরুরী। স্বাক্ষীর সাথে আগেই কেথা বলে নিবেন যেন তারা স্বাক্ষী দিতে আন্তরিত হয়।
স্বাক্ষীদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে রাখতে হবে মামলা করার আগে ভাগেই।
৯। চেক দাতার সঠিক নাম-ঠিকানা সংরক্ষন করা
চেক দাতার সঠিক নাম-ঠিকানা জানতে হবে। চেক গ্রহনের সময় দাতার ভোটার আইডি কার্ডের একটি কপি সংরক্ষণ করুন। নাম-ঠিকানা সঠিক না হলে মামলা করেও আসামীকে পাকড়াও করা সম্ভব হয়না এত মামলা নিষ্পত্তি হতে অনেক সময় লাগে।
অনেক সময় আসামীর ঠিকানা সঠিক না হওয়ায় সমন জারী হয়না বা গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হলেও পুলিশ আর আসামী খুজেঁ পায়না ফলে পত্রিকায় অনেক টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিতে হয় এবং মামলা নিষ্পত্তি হতেও অনেক সময় ব্যায় হয়।
১০। প্রতিনিধি নিযুক্ত করলে তার নামে ক্ষমতাপত্র বা আম-মোক্তারনামা সম্পাদন
যদি চেকদাতা কোন কারনে মামলা করতে অপারগ হয় তবে তাহার পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য যেকোন ব্যাক্তিকে প্রতিনিধি নিয়োগ করতে পারে।
যারা চাকরী বা অসুস্থ্যতার জন্য আদালতে আসতে পারেনা অথবা কোন প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানী ক্ষমতাপত্র বা আমমোক্তার নামা দলিলের মাধ্যমে মামলা পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ করতে পারে।
এ ক্ষেত্রে মনোনীত আম-মোক্তার বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রাতিনিধী চেক গ্রহীতার যাবতীয় অধিকার এবং পাওনার জন্য আদালতে সই-স্বাক্ষর প্রদান, আইনজীবী নিয়োগ এবং স্বাক্ষী প্রদান করতে পারে।
চেকের মামলায় আইনজীবী নিয়োগে সতর্কতা
চেকের মামলা অনেকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল বা সাধারণ মামলা মনে করে গুরুত্ব দেয় না। আমাদের আদালতে চেকের মামলা অনেক বেশী পরিমাণে হওয়ায় সব আইনজীবীরাই চেকের মামলায় কম-বেশী ধারণা রাখে।
মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী নিয়োগে কিছু জিনিসে আপোস করা চলবেনা যেমন,
(ক) মেধা, দক্ষতা, দূরদর্শিতা এবং স্মার্টনেস
যে কোন মামলার জয়-পরাজয়ের পিছনে আইনজীবীর প্রধান ভূমিকা থাকে। আইনজীবী সাবলীল উপস্থাপনা, উপস্থিত যুক্তি থন্ডন এবং আ্দালতে আইনের প্রাসঙ্গিক প্রয়োগ ও রেফারেন্স আদালতে পজিটিভ ইমেপেক্ট তৈরি করে।
কাজেই, আইনজীবী নিয়োগের সময় উপরোক্ত বৈশিষ্টগুলো ভাল ভাবে অবসারভেশন করা উচিৎ।
(খ) ফাইল এবং ডকুমেন্টস এর সংরক্ষণ ও জিম্মা
মামলা পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য আইনজীবী সেরেস্তায় নিদির্ষ্ট ফাইল সংরক্ষণ করা হয়।
দ্বায়িত্ববান আইনজীবীর প্রধান বৈশিষ্ট হচ্ছে মামলার ফাইল আপডেট রাখা এবং তা গোপনীয়তার সহিত সংরক্ষণ করা।
(গ) মূল কাগজপত্র আইনজীবীর কাছে না রাখাই শ্রেয়
চেকের মামলায় প্রত্যেকটা ডকুমেন্টসই সমান গুরুত্বপূর্ণ। যে কোন একটি ডকুমেন্টস হারিয়ে গেলে ভবিষ্যতে টাকা উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
নিরাপদ হেফাজতের কথা চিন্তা করে হলেও গুরুত্বপূর্ণ এসব নথী নিজের তত্বাবধনে রাখা উচিৎ।