মিথ্যা / গায়েবি মামলা হলে কি করবেন?
কবির সাহেব, সদ্য প্রবাস ফেরত একজন মানুষ। দীর্ঘ ২৫ বছর সিঙ্গাপুরের মাটিতে ইটের উপর ইট জোড়া দিয়ে ইমারত তৈরি করেছেন। তারুণ্য, যৌবন আর পরিশ্রম বিনিয়োগের বিপরীতে দেশে ফিরেছেন কিছু টাকা পয়সা নিয়ে। দীর্ঘ প্রবাসবাসে দেশে কিছু জমি জমাও কিনেছেন।
শেষ বয়সে সেই জমিই যেন কাল হয়ে দাড়িয়েছে কবির সাহেবের। এই জমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই চলছে পারিবারিক কোন্দল, ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া আর সাংসারিক অশান্তি। এরই মাঝে গতকাল বিকেলে এলাকার এক মেম্বার এর মাধ্যমে খবর পেয়েছেন যে, কবির সাহেবের অন্য ৩ ভাই মিলে তার নামে শিশু অপহরণের মামলা করেছেন আদালতে।
মিথ্যা মামলার খবর শুনে কবির সাহেবের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল, শুরু হল অসহনীয় দুশ্চিন্তা ও লাঞ্চনার কলঙ্কিত এক ইতিহাস।
কবির সাহেবের মত অগণিত লোক আছে আমাদের সমাজে যারা ‘ খায়া নেহি-পিয়া নেহি- মুসিবত মে ফাস গায়া’ টাইপের।
মামলায় জড়িয়ে মানসিক, সামাজিক ও আইনি কারাভোগ করে যাচ্ছ বিনাদোষে।
( মামলা জামিন )
চলুন জেনে নিই কি করবেন যদি আপনিও এমন বিপদে পড়েন?
মিথ্যা মামলা কি?
আসলে মিথ্যা মামলা বলতে কোন মামলা নেই। কথাটির শুদ্ধরূপ হল মিথ্যা অভিযোগে বা মিথ্যা ঘটনা সাজিয়ে দায়েরকৃত মামলা। যে ঘটনায় আপনার কোন অংশগ্রহণ নেই বা যে ঘটনার কোন বাস্তব অস্তিত্ব নেই সেসব সাজানো ঘটনায় মামলা হলে তাকে মিথ্যা মামলা বলে।
মিথ্যা মামলার আধুনিক সংস্করন হচ্ছে “গায়েবি মামলা”। প্রতিটা সাজানো ঘটনার মামলাই বাদীর কাছে সত্য এবং আসামির কাছে মিথ্যা।
প্রাথমিক করণীয় বিষয়াদি
১ম ধাপ
মিথ্যা মামলার ব্যাপারে জানতে পারলে প্রথমেই একজন আইনজীবীর মাধ্যমে সকল কাগজপত্র সংগ্রহ করতে হবে। জানতে হবে মামলার খুঁটিনাটি পদক্ষেপ ও বর্তমান অবস্থান। আপনার বিরুদ্ধে কোন সমন বা ওয়ারেন্ট আছে কিনা সেটা হচ্ছে সবচেয়ে জরুরী অনুসন্ধানী বিষয়।
২য় ধাপ
আপনার আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করে টেকনিক্যাল পথে সামনে আগাবেন মামলায় প্রতিদ্বন্ধিতা করার জন্য। ( মামলা জামিন )
৩য় ধাপ
জামিন : জামিন বর্তমানে খুব পরিচিত একটি শব্দ। মামলার যে কোন পর্যায়ে জামিন পেতে পারেন আপনি। মামলার গুরুত্ব, ধরন ও অপরাধের শ্রেণী অনুযায়ী মামলায় জামিন প্রাপ্তির বিষয়টা বিবেচিত হয়।
যে সব মামলায় নিম্ন আদালত জামিন দেয়া হয় না তার জন্য রয়েছে পর্যায়ক্রমে উচ্চ আদালতে জামিন চাওয়ার ব্যাবস্থা। মামলায় সমন হলে বা ওয়ারেন্ট হলে অবশ্যই যত দ্রুত সম্ভব জামিন নিতে হবে কারন এতে আপনার আইনের প্রতি আনুগত্য ও নির্দোষ মনের পরিচয় প্রকাশ পায় আদালতের কাছে।
সমনের আসামীর জামিন প্রাপ্তি ওয়ারেন্ট এর আসামীর তুলনায় অনেকটা সহজ। সঙ্গত কারনেই জামিনের ক্ষেত্রে অসুস্থ্য, বয়স্ক এবং মহিলা আসামীরা একটু বেশী সহানুভূতি পায় বটে।
আগাম জামিন যদি এমন হয় যে নিম্ন আদালতে সারান্ডার করলে আপনার জামিন পাওয়ার সম্ববনা নেই এবং এতে আপনার সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে, তাহলে মহামাণ্য হাইকোর্ট ডিভিসনে আগাম জামিন চাইতে পারেন।
যদিও আগে সবাই এই সুবিধার আওতায় ছিল কিন্তুু বর্তমানে দেখা যায় আগাম জামিনে মহিলা, বয়স্ক ও অসুস্থ্য নাগরিকরাই বেশি সুবিধা পায়।
আগাম জামিন নিয়ে আপনি বিচারিক আদালতে এসে মামলা কনটেস্ট করবেন।
মামলার বিচার ও স্বাক্ষ্য গ্রহণ:
বিখ্যাত বাকের ভাই চরিত্রের অনবধ্য নাকট ‘কোথাও কেউ নেই ‘ তে বাকের ভাইয়ের উকিলের বক্তব্য এখনো কানে বাজে। বক্তব্যটা ছিল ” সত্য মামলায় আসামীরা খালাস পেয়ে যায়, আর মিথ্যা মামলায় আসামীর সাজা হয়। কারন মিথ্যা মামলাগুলো করা হয় অতি সতর্কতার সাথে”।
তবে একটা বিষয় বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে, মিথ্য মামলায় যাদের সাজা হয় তারা কোন না কোন অপরাধে জড়িত ছিল বা আছে। তবে মামলা সত্য হোক আর মিথ্যা হোক স্বাক্ষ্য গ্রহণের সময় অবশ্যই মামলার গুরুত্ব দিতে হবে।
আইনজীবীর সহিত পর্যাপ্ত আলোচনার মাধ্যমে মামলার পারিপ্বার্শিক ঘটনা বিজ্ঞ আদালতে স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
পক্ষগণের মধ্যে অন্য কোন মামলা বা পারিবারিক কলহ, অন্তঃ দ্বন্ধ থাকিলে স্বাক্ষ্য প্রমাণে তা আদালতের দৃষ্টি গোচর করতে হবে।
একটি বাস্তব গল্প বলি,
এক মামলায় জজ সাহেব এক আসামীকে যাবজ্জীবন সাজা দেন।
কারন, আসামী একদিন ট্রেন স্টেশনে দাড়ানো ছিল এবং পাশে একটি মহিলা বড় একটি ব্রিফকেস নিয়ে দাড়ানো ছিল। মহিলা টিকেট কাটতে ব্রিফকেসটি আসামীর পাশে রেখে যান। পুলিশ এসে আসামীর পাশে থাকা ব্রিফকেস ঘেটে একটি বাচ্চার গলা কাটা লাশ পান।
স্বাক্ষ্য প্রমাণে দোষী পাওয়ায় আদালত আসামীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন। পরে জজ সাহেবের মনে হল তিনি ভুল করেছেন এবং আসামির সহিত দেখা করেন ক্ষমা চাইতে।
জজ সাহেবের কথাশুনে আসামী বলেন যে আসলে জজ সাহেব আপনার কোন দোষ নেই, আমি ২৩ বছর আগে একটি মেয়েকে হত্যা করে পানিতে ফেলে দিয়েছিলাম যা কেউ জানতনা আল্লাহ ছাড়া, তাই আজ আপনার কাছে আমার ২৩ বছর আগের সেই অপরাধের সাজা পেলাম এই মিথ্যা মামলায়।
মিথ্যা মামলা দিলে কি শাস্তি ?
যদি কেউ আপনার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয় এবং আপনি নির্দোষ প্রমানিত হন তাহলে আপনি আদালতে মিথ্যা মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে সরাসরি আদালতে মামলা দিতে পারবেন যার সাজা ১ হাজর টাকা জরিমানা ও ১ মাসের জেল।
শুধু কি তাই, কেউ মিথ্যা স্বাক্ষ্য দিলে তার বিরুদ্ধেও আদালতে অভিযোগ করতে পারবেন যাহার জন্য মৃতু্দন্ড, যাবজ্জীবন সহ কঠিন শাস্তির বিধান রয়েছে।
মিথ্যা মামলা যদি পুলিশ বা সরকারি অন্য কোন সংস্থা দিয়ে থাকে তার বিরুদ্ধে সরাসরি স্পেশাল জজ আদালতে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ এবং দুর্নীতির অভিযোগ দাখিল করা ছাড়াও ক্ষমতা সম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রট আদালতে ফৌজদারি আইনে ব্যাবস্থা নিতে পারবেন।