বন্ড বা স্ট্যাম্পে চুক্তি করে ৩/৫ বছর চাকুরী করার শর্তে নিয়োগ অবৈধ
আমাদের দেশে বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এবং কিছু কিছু ব্যাংকে চাকরীতে প্রবেশের ক্ষেত্রে অন্যতম শর্ত থাকে যে, ৩/৫ বছর পূর্ণ হবার আগে চাকুরী ছাড়া যাবেনা। চাকুরী ছাড়লেও নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জরিমানা হিসাবে দেবার শর্ত থাকে। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার চেক নিয়ে রাখে এবং প্রার্থীর মূল কাগজপত্র জব্দ করে রাখে।
প্রতিযোগীতার বাজারে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই ভাল-মন্দ বিবেচনা না করেই চাকরিতে জয়েন করে। পরবর্তীতে, ভাল কোন চাকুরী হলেও চুক্তিপত্র বা সার্টিফিকেট জব্দ থাকার কারনে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকুরীতে জয়েন করতে পারেন না। কৌশলী প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের চুক্তির কারণে অনেক তরুণের ক্যারিয়ার হুমকির সম্মুখীন হয়।
জোর করে যেমন ভালবাসা হয় না। তেমনি কাউকে নির্দিষ্ট মেয়াদের চুক্তি সই করিয়ে কোনো চাকরিতে থাকতে বাধ্য করা যায় না। এ ধরনের সমস্ত চুক্তি আইনত সম্পূর্ণ অবৈধ, অসাংবিধানিক এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
বন্ড, স্ট্যাম্প অথবা সনদপত্র জব্দ করে চাকরি করানো কি আইন সম্মত?
কোনো প্রতিষ্ঠানই কর্মীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর পূর্বক চাকুরী করতে বাধ্য করতে পারেনা। এরকম জোরপূর্বক কাজ করানো কে আইনে জবরদস্তী শ্রম বলে। কোন শ্রমিক বা কর্মীকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চাকুরীতে নিয়োজিত রাখতে তার সনদপত্র, চেক, স্ট্যাম্প বা বন্ড সই করানো জবরদস্তী শ্রমের কাতারে পড়ে যা বে-আইনী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেউ যদি চুক্তি ভিত্তিক মেয়াদে চাকুরীতে জয়েন করেও থাকেন মনে রাখবেন কেবল নোটিশ পিরিয়ড মেনেই আপনি চাকুরী ত্যাগ করতে পারবেন।
আইন কি বলে?
বাংলাদেশের সকল আইনের অভিভাবক হল বাংলাদেশের সংবিধান। সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদে সকল প্রকার জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সাংবিধানিক এই নিষেধাজ্ঞা কেউ লঙ্গন করলে তা আইনের চরম লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে।
এছাড়া, আন্তর্জাতিক ভাবে জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) ১৯৫৭ সালে একটি করভেনশন পাশ করে। “বল প্রয়োগ শ্রমের বিলোপসাধন কনভেনশন-১৯৫৭” নামের এই কনভেনশনটি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হইলে সরকার কর্তৃক তা অনুসমর্থিত হয়। যেহেতু, বাংলাদেশ আন্তজার্তিক এই কনভেনশনটি সমর্থন করে কাজেই এটা বাস্তবায়ন করাও বাংলাদেশের দ্বায়িত্ব।
সেই প্রেক্ষিতে, ২০০৬ সালে আমাদের দেশে শ্রম আইন প্রনয়ন করা হয়। শ্রম আইনের ২৭ ধারায় একজন কর্মী বা শ্রমিকের চাকুরী ত্যাগের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কোনো শ্রমিক প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করতে চাইলে সে ২৭ ধারা অনুসরণ করে পদত্যাগ করে প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করতে পারেন।
কর্তৃপক্ষ উক্ত শ্রমিকের পদত্যাগ অনুমোদন না করলেও শ্রমিক কর্তৃক প্রদত্ত নোটিশের সময় অতিক্রম হলে অথবা নোটিশের পরিবর্তে উল্লিখিত মজুরি প্রদান করলে উক্ত শ্রমিকের দায় শেষ এবং মালিক তাকে আর কোনোভাবে চাকরী করতে বাধ্য করতে পারবেনা বলা হয়েছে।
বন্ড বা চুক্তিপত্র দিয়ে কি কোম্পানী মামলা করতে পারবে?
সব ধরনের নিয়োগে বন্ড বা সার্ভিস ডিড আইন অনুসারে অবৈধ, কাজেই এর বিপরীতে কোনো আইনি লড়াইয়ে কোনদিন কোম্পানি জয়ী হতে পারবে না। সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের-২১ ধারা অনুসারে এ ধরনের চুক্তি আদালত দ্বারা কার্যকর করা যায় না। কাজেই, ভাল জবের সুযোগ থাকলে তা হাতছাড়া করবেন না। আইনগত ঝামেলা হবে ভেবে নিজের ভবিষ্যৎ স্থবির করে দিবেন না। অনেকে প্রশ্ন করেন, কোম্পানী যদি মামলা দেয় তাহলে পরবর্তী চাকুরীতে অসুবিধা হবে কিনা? এ বিষয়ে আমাদের অন্য একটি ভিডিও আছে –
মামলা থাকলে চাকুরী হয় কিনা? (দেখুন)
বিনিয়োগ চুক্তির টাকা কি ফেরত দিতে হবে?
কোম্পানি তার কর্মীর পেশাগত উন্নয়ন, মানসিক প্রশান্তি এবং সামাজিক স্ট্যাটাস বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ করে এবং কখনো এই বিনিয়োগ নির্দিষ্ট সময় ঐ প্রতিষ্ঠানে কাজ করার শর্তে করা হয়।
যেমন,
১। কর্মীকে ফ্ল্যাট/গাড়ী কিনে দেয়া।
২। বাড়ি তৈরিতে অর্থায়ন করা।
৩। বৈদেশিক ট্রেনিং বা বৃত্তিতে অর্থায়ন করা।
যেহেতু, কোম্পানী কর্তৃক কর্মীকে নির্দিষ্ট সময় চাকুরীতে থাকতে আকৃষ্ট করার জন্য অতিরিক্ত এসব সুবিধা প্রদান করেছে কাজেই, কর্মী বর্ণিত মেয়াদ শেষ হবার আগে চাকুরী ত্যাগ করতে চায় তবে, চুক্তি অনুযায়ী কোম্পানীর বিনিয়োগের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান করবে। এ ধরনের চুক্তি আইনসম্মত এবং বৈধ। এক্ষেত্রে যদি ৫ বছরের মেয়াদকালের মধ্যে ৩ বছর পার হয়ে যায় তাহলে বাকী ২ বছর হিসাবে পে-ব্যাক করতে হয়।
কারো চেক বা সার্টিফিকেট আটকে রাখালে কি করবেন ?
চাকুরী দাতা প্রতিষ্ঠান যদি আপনাকে বাধ্য করে কোন তারিখ বিহিন চেক বা স্ট্যাম্প আদায় করে তাহলে সম্পূর্ণ ঘটনার বিবরণ দিয়ে থানায় জিডি করুন। জিডির কপিটি সংরক্ষণ করুণ।
জিডির কপি নিয়ে কোম্পানিতে কাগজপত্র/চেক ফেরত চেয়ে এবং চুক্তিটি বাতিল মর্মে ঘোষণা করে একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর মাধ্যমে লিগ্যাল নোটিশ পাঠাবেন।
আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বেশিরভাগ কোম্পানীই লিগ্যাল নোটিশ পেলে আইনী ঝামেলা এড়াতে প্রার্থীর সাথে তর্কিত বিষয়টি সুরাহা করে ফেলে। যদি নোটিশে সুরাহা না হয়, আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন।
ব্যাংকে আপনার চেক নাম্বার উল্লেখ পূর্বক দরখাস্ত করে বর্নিত চেকেও লেনদেন বন্ধ করে দিন। দরখাস্তের সাথে জিডি এবং লিগ্যাল নোটিশের কপি সংযুক্ত করে সংশ্লিষ্ট চেকটি ব্যাংকে উপস্থাপন করা হলে ব্যাংক কর্তৃক জব্দ করার আবেদন করুন।
যদি চুক্তি সই করা লাগে, কি ধরনের সচেতনা অবলম্বন করবো ?
স্রোতের সাথে তাল মেলানো আমাদের স্বভাব। সবাই যেহেতু চুক্তি সই করে জব করছে, আপনি না করেও পারবেন না। তাই কখনো যদি এ ধরনের এগ্রিমেন্ট করাই লাগে তাহলে অবশ্যই একমাসের নোটিশে জব চেঞ্জ করার শর্ত রাখবেন।
অরিজিনাল কাগজ চাইলে যথা সম্ভব না দেয়ার চেষ্টা করুন। একদম নিরুপায় হলে কাগজপত্র দিবেন।
দিয়ে সোজা থানায় গিয়ে জিডি করবেন। যে কর্মকর্তা আপনার কাগজ নিয়েছে তার নাম উল্লেখ করে জিডি করবেন।
জিডি করে চুপচাপ আরামসে চাকুরী করুন। অন্য কোথাও জব হলে, এক মাস বা দুই মাস আগে নোটিশ দিন।
কাগজপত্র ফেরত না দিলে, থানায় জানান এবং লিগ্যাল নোটিশ দিন।