সত্যায়নের বিড়ম্বনায় বাড়ছে মিথ্যায়ন !

সত্যায়নের বিড়ম্বনায় বাড়ছে মিথ্যায়ন !

আমাদের দেশে সরকারী বা বে-সরকারী বিভিন্ন চাকুরী, পাসপোর্ট এর আবেদন কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে ছবি এবং সকল কাগজ পত্রের সত্যায়িত কপি (Attested Copy) চাওয়া হয়। সত্যায়নকারী আর সত্যায়ন প্রার্থী উভয়ের জন্য এটি একটি বিরক্তিকর এবং অপ্রয়োজনীয় কাজ বলে মনে হয়। সত্যয়নের এই পদ্ধতি মানুষকে হাতে ধরে চুরি শেখানোর মত। কারন বিপদে পড়ে মানুষ অনেক সময় অন্যায় করে, মিথ্যার আশ্রয় নেয়। এমনি একটি ব্যপার এটি।

সত্যায়নের জন্য গেলে কিছু কর্মকর্তাগন সত্যায়নপ্রার্থীকে ভিক্ষুকের চাইতেও নিচু স্তরের মনে করে যা ইচ্ছে তাই ব্যবহার করে তবে সকল কর্মকর্তাগন এমনটা করেন না। সত্যায়ন প্রক্রিয়া মূলত জনগনের দাসভিত্তিক মানসিকতা ধরে রাখার জন্য একটি ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক দৃষ্টান্ত মাত্র।

আরেকটা বিশ্রী সিস্টেম হল চারিত্রিক সনদ। মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে যিনি এটি দিচ্ছেন তার চরিত্র যে খুব ভালো, তার চরিত্র যে ফুলের মত পবিত্র এই গ্যারান্টিটা কে দিচ্ছে? চারিত্রিক সনদ দাতা-গ্রহীতা এক অপরের পরিচিত না হলে বা খুব ঘনিষ্ঠ না হলে কিভাবে চরিত্রের ধারনা পাবে? চারিত্রিক সনদ এর পরিবর্তে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স নেয়া যেতে পারে থানা থেকে। আবেদন কারীর নামে কোন মামলা-মোকদ্দমা আছে কিনা? কোন অপরাধ ইতিহাস বা দাঙ্গা-হাঙ্গামায় জড়িত কিনা ইত্যাদি বিষয়ে। একজন নতুন চাকরি প্রত্যাশি কিংবা নব্য বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছু প্রার্থীকে এ নিয়ে চরম বিপাকে পরতে হয়, মাঝে মাঝে হয়রানির শিকারও হতে হয়। এই হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে সত্যায়ন এর আড়ালে সত্যায়নের নামে বেশিরভাগ মানুষই মিথ্যায়নের আশ্রয় নেয়।

Attestation Process In Bangladesh

এইতো কিছুদিন আগে গ্রাম থেকে আমার এক ছোট ভাই ঢাকা এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হতে। ঢাকায় আমি ছাড়া ওর তেমন পরিচিত কেউ নেই। ভর্তি হতে যাবার আগের দিন আমার কাছে এসে বলল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ওর ছবি আর কাগজপত্র সত্যায়িত করে দিতে হবে। আমি বললাম ওকে তুই ওগুলো রেখে যা আমি রাতে আমার বড় ভাইয়ার বাসায় গিয়ে সত্যায়িত করে এনে রেখে দিবনে, তুই সকালে এসে নিয়ে যাস। আমি আমার কোন কিছু সত্যায়িত করার প্রয়োজন হলে ওনার কাছ থেকে করিয়ে রাখি যেহেতু উনি একজন প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা।

ছোট ভাইটা আমাকে বলল ভাইয়া আমাকে এখনি সত্যায়ন করে দেন, কাল সকালেই আমার ভর্তি, এদিকে সকালে আসার সময় পাবনা আর, আপনিই সাইন দিয়ে সত্যায়ন করে দেন। আমি ওকে বললাম আমি তো প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা না যে আমার সাইনে সত্যায়িত হবে। আমি এই কথা বলা মাত্রই সে তার পকেট থেকে একখানা সিল বের করে আমাকে দিয়ে বলল ভাই এটা নীলক্ষেত থেকে ৫০ টাকা দিয়ে বানিয়ে এনেছি। আপনি এই নামে একটা সাইন দিয়া দেন। আমি সাইন দিতে রাজি হইনি এ কারনে ওইদিন রাগ করে ও চলে গেছে। কয়েক মাস পরে হঠাৎ ওর সাথে আমার দেখা, ও বলল ভাই ওইদিন আপনি সাইন দেন নাই পরে আমি নিজেই সাইন দিয়া সত্যায়ন করে নিছিলাম আর ওই সাইন এর সত্যায়িত কাগজ পত্র দিয়েই আমি ভর্তি হইছি।

পরে আমি ভেবে দেখলাম যারা সত্যায়ন নামে এমন মিথ্যায়নের আশ্রয় নেয় তারা এমন করবেই না কেন? তারা তো সাধে এমন করে না। আমি এমন অনেক প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাকে দেখেছি যারা নানা অজুহাতে সত্যায়ন করে দিতে অপারগত স্বীকার করে। এর পিছেনও যৌক্তিক কারন আছে। যে ব্যক্তি সম্পর্কে তিনি চিনেনা জানেনা তার সত্যায়ন তিনি কিভাবে করবেন, করেও আবার কোন বিপদে পরেন। এই দায় এড়ানোর জন্য অনেকে সত্যায়ন করে দিতে রাজী হয়না হয়তো। এর ফলে সত্যায়ন নামের মিথ্যায়ন করতে একধরনের বাধ্য হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষেরা।

ইচ্ছায় করুক আর প্রয়োজনের তাগিদে করুক আইনের দৃষ্টিতে এটি প্রতারণা যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই সত্যায়ন পদ্ধতিটির আইনী কোন ভিত্তি আছে বলে আমার জানা নাই। এটি কেবলই একটি ঔপনিবেশিক প্রথা। এমন একটি ঔপনিবেশিক এবং যুগঅনুপযোগী প্রথার জন্য লাখ তরুণ বিশ্বাবিদ্যালয়ে ভর্তি প্রার্থী, চাকরি প্রার্থী এমন অন্যায় করতে বাধ্য হচ্ছে। যেখানে বর্তমান সরকার অন্যায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষনা দিচ্ছে সেখানে সত্যায়নের নামে মিথ্যায়ন আমাদের কাম্য নয়।

এই প্রথা থেকে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত যদি বেরিয়ে আসতে পারে তবে আমরা কেন নয়? ২০১৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ভারতেও এ পদ্ধতিটির প্রচলন ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ১ তারিখ থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা কতৃক সত্যায়ন পদ্ধতি বাতিল করা হয়। ভারতের মত বাংলাদেশও এই সত্যায়ন পদ্ধতিটি বাতিল করা হোক এবং সত্যায়ন নামের এই মিথ্যায়নের বিড়ম্বনা থেকে লাখ তরুণ এবং সাধারণ মানুষকে রেহাই দেয়া হোক।

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *